ঢাকা ০৬:৪২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
উপজেলা পর্যায়ে সরকারি বিদ্যমান সেবা বিষয়ে ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠিত মদনে প্রাণিসম্পদের উদ্যোগে মোরগ ও ছাগলের খাদ্য বিতরণ ইটনায় সরকারি বিদ্যমান সেবা বিষয়ে অবহিতকরণ সভা অনুষ্ঠিত মদনে সংবাদ প্রকাশের পর স্কুল কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙ্গল বিদ্যালয় প্রাঙ্গন দখল করে ঘর নির্মাণ করছেন শিক্ষক রাজধানীতে পার্বত্য জেলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ বিপনী বিতান উদ্বোধন করেন: পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী সীমান্ত সড়ক পশ্চাদপদ পার্বত্য অঞ্চলকে উন্নয়নের স্রোতধারায় একীভূত করেছে মদন উপজেলা ছাত্র কল্যাণ পরিষদের সভাপতি সায়েম সাধারণ সম্পাদক আরিফ মদনে ফের বয়রাহালা ব্রীজের এপ্রোচ দখল করে ঘর নির্মাণ মদনে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে কৃষককে হত্যার চেষ্টা

আমনে জাগছে আশার আলো

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৫৪:০৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর ২০১৭
  • ২৩৯ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ অগ্রহায়ণ শুরু হয়ে গেছে। ক্ষেতগুলো ভরে আছে সোনালি ধানে। নতুন ধান উঠেছে কৃষকের ঘরে। হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখেও। কারণ এবার আমনের ফলনও বেশ ভালো। ধান কাটা, মাড়াই, গোলায় তোলা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে কৃষক। তার আঙিনাজুড়ে ছড়িয়ে আছে ধানের স্তূপ। গ্রামে গ্রামে চলছে নবান্নের আয়োজন। গত বোরো মৌসুমে অতিবৃষ্টি, বন্যা ও ব্লাস্ট রোগে উৎপাদনে ঘাটতির জেরে বাজারে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছিল, আমন তাতে কিছুটা লাগাম টানতে পারবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কৃষক, চালকল মালিক, ধান-চালের ব্যবসায়ী ও কৃষি কর্মকর্তারা শোনালেন এ স্বস্তির খবর ।

সেখানে লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের আনুর বাজার গ্রামের রমজান আলীর বাড়িতে গেলে কথা হয় তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন আরার সঙ্গে। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। নতুন ধানের চাল থেকে আটা তৈরি করছিলেন ইয়াসমিন। পিঠা বানাবেন। হেসে বললেন, ‘নতুন ধানের পিঠা-পায়েস না খাইলে কি হয় !’

গত বুধবার ছিল অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিন। কোলকোন্দ ইউনিয়নের দক্ষিণ কোলকোন্দ গ্রামের কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, ‘যদিও আগাম জাতের ধান অনেক আগেই কাটা হয়েছে, তার পরও আমরা কয়েক বছর থেকে অগ্রহায়ণের প্রথম তারিখেই নবান্নের আয়োজন করে থাকি। ’

পীরগাছা উপজেলার কল্যাণী ইউনিয়নের তালুক উপাসু গ্রামের ভাই ভাই চালকলে গিয়ে দেখা যায়, ধান ভাঙাতে উপচে পড়ছে ভিড়। চালকলের মালিক শাহ আলম জানান, এক মাস আগে থেকেই আগাম জাতের ধান কিছু কিছু কাটা শুরু হয়েছে। শুরুতে তেমন ভিড় ছিল না। কিন্তু নবান্ন ঘিরে দুই দিন থেকে কৃষকরা ধান ভাঙাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় পাঁচ লাখ ৯৩ হাজার ৪৫৬ হেক্টর জমিতে রোপা আমন ধানের চাষ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ লাখ ৫৯ হাজার ২২৪ মেট্রিক টন চাল। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ও আগাম জাতের ধান কৃষকের ঘরে উঠতে শুরু করেছে। এ বছর অতিবৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়াসহ নানা প্রতিকূলতার পরও আশানুরূপ ফলন হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ধান কাটা ও মাড়াই চলছে পুরোদমে। পা-চালিত ধান মাড়াই যন্ত্রের ঘর্ঘর শব্দ সরব করে তুলেছে গ্রামাঞ্চল।

ঢাকায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এ বছর সারা দেশে ৫৩ লাখ পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে রোপা আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। তবে চাষ হয়েছে আরো ৬০ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৩৭ হাজার টন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হাওর বার্তাকে বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর কৃষকরা বেশি করে আমন লাগিয়েছে। অনেকে অন্যান্য ফসল বাদ দিয়ে আমন করেছে। বিগত যেকোনো বছরের চেয়ে এবার আমনের ফলন ভালো হবে। তবে এখনো পূর্ণমাত্রায় ধান তোলা শুরু হয়নি। এটা শুরু হলে চালের বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আমরা আশাবাদী। কারণ বন্যার পর পলিতে ভালো ফলন হয়। ’

গত অর্থবছরের শেষ দিকে অতিবৃষ্টি ও বন্যায় চাল উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক কোটি ৯১ লাখ টন। শেষ পর্যন্ত ৪৭ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হলেও বোরো কাটার ঠিক আগ মুহূর্তে ভারি বৃষ্টি হয়। এতে হাওর এলাকার ধান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট সরকারকে জানিয়েছে, বন্যা ও ব্লাস্ট রোগের কারণে বোরোর ফলন ৫ শতাংশ কম হয়েছে। ওই অর্থবছর আউশের ফলনও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ শতাংশ কম ছিল।

তবে সাবেক কৃষিসচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী বলেন, ‘আমনের ওপর ভরসা করে বসে থাকলে চলবে না। কারণ আমাদের দেশে কৃষকরা সাধারণত আমন ধান বিক্রি করে না। এটা তাদের নিজেদের খাবারের জন্য রেখে দেয়। সর্বোচ্চ দু-তিন লাখ টন চাল হয়তো আমন মৌসুমে সংগ্রহ করতে পারবে খাদ্য অধিদপ্তর। কাজেই আমন ভালো হলেও সরকারকে আমদানির ওপরই নির্ভর করতে হবে। এই নির্ভরতা আগামী বোরো মৌসুম পর্যন্ত চলতে থাকবে। ’

যদিও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে কেবল সরকারিভাবে নয়, বেসরকারিভাবেও চাল আমদানি বেড়েছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সংরক্ষিত নিত্যপণ্য আমদানির মাসিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে চাল আমদানির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৪৪ কোটি ৭১ লাখ ডলার, যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ছিল ৩২ লাখ ডলার। সেই হিসাবে চালের আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৪০ গুণ।

তা ছাড়া চালের দাম কমানোর জন্য সরকার খোলাবাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) শুরু করলেও আতপ চাল কিনতে আগ্রহ দেখায়নি ক্রেতারা। সিদ্ধ চাল খোলাবাজারে বিক্রি করলে দাম আরো কমত বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

যশোর থেকে বিশেষ প্রতিনিধি ফখরে আলম জানান, এবার যশোর জেলায় এক লাখ ২৭ হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২.৭ মেট্রিক টন চাল। সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘এরই মধ্যে ৪০ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। বর্ষায় কিছুটা ক্ষতি হলেও যে ধান আছে তার ফলন খুবই ভালো। আমরা ধারণা করছি তিন লাখ ৪২ হাজার ৯০০ মেট্রিক  টনেরও বেশি চাল উৎপাদিত হবে। ’

সরেজমিন যশোর সদর উপজেলার ভাতুড়িয়া দাড়িপাড়ার মাঠ ঘুরে দেখা যায়, দল বেঁধে চাষিরা আমন ধানক্ষেতে কাজ করছে।

মণিরামপুর উপজেলা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মথুরাপুর গ্রাম। এ গ্রামের তিন মাঠে ৫০০ বিঘা জমি রয়েছে। এসব জমিতে গুটি স্বর্ণ ধানও বেশি চাষ করা হয়েছে। আনোয়ার তরফদার তিন বিঘা জমির ধান কেটে ঘরে তুলেছেন। তাঁর মা সকিনা বেগম বললেন, ‘ধানই আমাদের সব। নিজেরা খাই, বিক্রি করি। ধান বিক্রির টাকায় সংসার চলে। ’ এ গ্রামের ওসমান তরফদার খুবই ব্যস্ত। তিন বিঘা জমির গুটি স্বর্ণ ধান কাটা শেষ। তিনি বললেন, ‘বর্ষায় কিছুটা ক্ষতি হলেও ফলন মন্দ না। ’ স্থানীয় নতুন হাটের ধান ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বললেন, ‘নতুন স্বর্ণ ধান বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ৮৫০ থেকে ৮৬০ টাকা। বিনা-৭ বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ৮৬০ টাকা, হাবু ধান বিক্রি হচ্ছে ৯৫০ থেকে এক হাজার টাকায়। নতুন ধান ওঠার কারণে দাম কিছুটা কমেছে। ’

নওগাঁ প্রতিনিধি ফরিদুল করিম জানান, এবার রোপা আমনের সময় নওগাঁ জেলায় বন্যায় ৩৮ হাজার ৪৩১ হেক্টর ধানি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো ব্যাপকভাবে ধান কাটা শুরু হয়নি। গত বুধবার পর্যন্ত ২৩ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে।

তবে কৃষকরা জানিয়েছে, রোপা আমন চাষে সার, কীটনাশক, জমি প্রস্তুত, ক্ষেতমজুরের পেছনে যে খরচ হয়েছে, তাতে কুলিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে যাবে। সবে হাট-বাজারগুলোতে ধান উঠতে শুরু করেছে। ফলে দাম একটু চড়া। তবে এক সপ্তাহ বাদেই ওই দামে হেরফের হবে। শুকনো ধানের দামই একটু বেশি পড়ছে।

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি সূত্রে জানা যায়, নওগাঁয় এবার রোপা আমন ধান চাষ হয়েছিল দুই লাখ ১৪০ হেক্টর জমিতে। বন্যায় বেশ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত টিকেছে এক লাখ ৬১ হাজার ৬৯৯ হেক্টর জমির ধান। এবার প্রতি বিঘা জমিতে উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে সাড়ে ১৬ মণ। চাল হওয়ার কথা বিঘায় ১১ মণ করে।

রাইগাঁ গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম (৪৫) জানালেন, ধান চাষে যে পরিমাণ খরচ পড়েছে, বিশেষ করে সার ও কীটনাশক ব্যবহারের পেছনে যে খরচ পড়েছে, সেই তুলনায় বাজারে ধানের মূল্য কম। তাই লোকসান হচ্ছে।

ধান ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন খান টিপু বলেন, হাট-বাজারে সবে নতুন ধান উঠতে শুরু করেছে। ব্যাপক হারে ধান উঠতে আরো ৮-১০ দিন অপেক্ষা করতে হবে। যেটুকু ধান হাটে কৃষকরা আনছে, তা ধান কাটার খরচের টাকার জন্য। এ দিয়ে তারা কৃষি শ্রমিকের মজুরিসহ অন্যান্য খরচ মেটাবে। ফলে শুখনো ধানের জন্য আরো সময় লাগবে।

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মনোজিৎ কুমার মল্লিক বলেন, গড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এই কয়েক দিনে ২৩ শতাংশ জমির রোপা আমন ধান কাটা হয়েছে। বন্যা ও বন্যার আগে বৃষ্টিতে রোপা আমন ধান চাষে কৃষকরা চরম বিড়ম্বনায় পড়ে। বন্যার পর অনেক কৃষক চিনি আতপ ধান চাষ করেছে। ওই ধান উঠতে একটু দেরি হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন জাতের ধানের ফলনও পৃথক। ফলে গড় উৎপাদনের হিসাব পেতে একটু সময় লাগবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

উপজেলা পর্যায়ে সরকারি বিদ্যমান সেবা বিষয়ে ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠিত

আমনে জাগছে আশার আলো

আপডেট টাইম : ১১:৫৪:০৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ অগ্রহায়ণ শুরু হয়ে গেছে। ক্ষেতগুলো ভরে আছে সোনালি ধানে। নতুন ধান উঠেছে কৃষকের ঘরে। হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখেও। কারণ এবার আমনের ফলনও বেশ ভালো। ধান কাটা, মাড়াই, গোলায় তোলা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে কৃষক। তার আঙিনাজুড়ে ছড়িয়ে আছে ধানের স্তূপ। গ্রামে গ্রামে চলছে নবান্নের আয়োজন। গত বোরো মৌসুমে অতিবৃষ্টি, বন্যা ও ব্লাস্ট রোগে উৎপাদনে ঘাটতির জেরে বাজারে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছিল, আমন তাতে কিছুটা লাগাম টানতে পারবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কৃষক, চালকল মালিক, ধান-চালের ব্যবসায়ী ও কৃষি কর্মকর্তারা শোনালেন এ স্বস্তির খবর ।

সেখানে লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের আনুর বাজার গ্রামের রমজান আলীর বাড়িতে গেলে কথা হয় তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন আরার সঙ্গে। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। নতুন ধানের চাল থেকে আটা তৈরি করছিলেন ইয়াসমিন। পিঠা বানাবেন। হেসে বললেন, ‘নতুন ধানের পিঠা-পায়েস না খাইলে কি হয় !’

গত বুধবার ছিল অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিন। কোলকোন্দ ইউনিয়নের দক্ষিণ কোলকোন্দ গ্রামের কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, ‘যদিও আগাম জাতের ধান অনেক আগেই কাটা হয়েছে, তার পরও আমরা কয়েক বছর থেকে অগ্রহায়ণের প্রথম তারিখেই নবান্নের আয়োজন করে থাকি। ’

পীরগাছা উপজেলার কল্যাণী ইউনিয়নের তালুক উপাসু গ্রামের ভাই ভাই চালকলে গিয়ে দেখা যায়, ধান ভাঙাতে উপচে পড়ছে ভিড়। চালকলের মালিক শাহ আলম জানান, এক মাস আগে থেকেই আগাম জাতের ধান কিছু কিছু কাটা শুরু হয়েছে। শুরুতে তেমন ভিড় ছিল না। কিন্তু নবান্ন ঘিরে দুই দিন থেকে কৃষকরা ধান ভাঙাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় পাঁচ লাখ ৯৩ হাজার ৪৫৬ হেক্টর জমিতে রোপা আমন ধানের চাষ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ লাখ ৫৯ হাজার ২২৪ মেট্রিক টন চাল। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ও আগাম জাতের ধান কৃষকের ঘরে উঠতে শুরু করেছে। এ বছর অতিবৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়াসহ নানা প্রতিকূলতার পরও আশানুরূপ ফলন হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ধান কাটা ও মাড়াই চলছে পুরোদমে। পা-চালিত ধান মাড়াই যন্ত্রের ঘর্ঘর শব্দ সরব করে তুলেছে গ্রামাঞ্চল।

ঢাকায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এ বছর সারা দেশে ৫৩ লাখ পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে রোপা আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। তবে চাষ হয়েছে আরো ৬০ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৩৭ হাজার টন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হাওর বার্তাকে বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর কৃষকরা বেশি করে আমন লাগিয়েছে। অনেকে অন্যান্য ফসল বাদ দিয়ে আমন করেছে। বিগত যেকোনো বছরের চেয়ে এবার আমনের ফলন ভালো হবে। তবে এখনো পূর্ণমাত্রায় ধান তোলা শুরু হয়নি। এটা শুরু হলে চালের বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আমরা আশাবাদী। কারণ বন্যার পর পলিতে ভালো ফলন হয়। ’

গত অর্থবছরের শেষ দিকে অতিবৃষ্টি ও বন্যায় চাল উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক কোটি ৯১ লাখ টন। শেষ পর্যন্ত ৪৭ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হলেও বোরো কাটার ঠিক আগ মুহূর্তে ভারি বৃষ্টি হয়। এতে হাওর এলাকার ধান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট সরকারকে জানিয়েছে, বন্যা ও ব্লাস্ট রোগের কারণে বোরোর ফলন ৫ শতাংশ কম হয়েছে। ওই অর্থবছর আউশের ফলনও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ শতাংশ কম ছিল।

তবে সাবেক কৃষিসচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী বলেন, ‘আমনের ওপর ভরসা করে বসে থাকলে চলবে না। কারণ আমাদের দেশে কৃষকরা সাধারণত আমন ধান বিক্রি করে না। এটা তাদের নিজেদের খাবারের জন্য রেখে দেয়। সর্বোচ্চ দু-তিন লাখ টন চাল হয়তো আমন মৌসুমে সংগ্রহ করতে পারবে খাদ্য অধিদপ্তর। কাজেই আমন ভালো হলেও সরকারকে আমদানির ওপরই নির্ভর করতে হবে। এই নির্ভরতা আগামী বোরো মৌসুম পর্যন্ত চলতে থাকবে। ’

যদিও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে কেবল সরকারিভাবে নয়, বেসরকারিভাবেও চাল আমদানি বেড়েছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সংরক্ষিত নিত্যপণ্য আমদানির মাসিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে চাল আমদানির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৪৪ কোটি ৭১ লাখ ডলার, যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ছিল ৩২ লাখ ডলার। সেই হিসাবে চালের আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৪০ গুণ।

তা ছাড়া চালের দাম কমানোর জন্য সরকার খোলাবাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) শুরু করলেও আতপ চাল কিনতে আগ্রহ দেখায়নি ক্রেতারা। সিদ্ধ চাল খোলাবাজারে বিক্রি করলে দাম আরো কমত বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

যশোর থেকে বিশেষ প্রতিনিধি ফখরে আলম জানান, এবার যশোর জেলায় এক লাখ ২৭ হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২.৭ মেট্রিক টন চাল। সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘এরই মধ্যে ৪০ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। বর্ষায় কিছুটা ক্ষতি হলেও যে ধান আছে তার ফলন খুবই ভালো। আমরা ধারণা করছি তিন লাখ ৪২ হাজার ৯০০ মেট্রিক  টনেরও বেশি চাল উৎপাদিত হবে। ’

সরেজমিন যশোর সদর উপজেলার ভাতুড়িয়া দাড়িপাড়ার মাঠ ঘুরে দেখা যায়, দল বেঁধে চাষিরা আমন ধানক্ষেতে কাজ করছে।

মণিরামপুর উপজেলা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মথুরাপুর গ্রাম। এ গ্রামের তিন মাঠে ৫০০ বিঘা জমি রয়েছে। এসব জমিতে গুটি স্বর্ণ ধানও বেশি চাষ করা হয়েছে। আনোয়ার তরফদার তিন বিঘা জমির ধান কেটে ঘরে তুলেছেন। তাঁর মা সকিনা বেগম বললেন, ‘ধানই আমাদের সব। নিজেরা খাই, বিক্রি করি। ধান বিক্রির টাকায় সংসার চলে। ’ এ গ্রামের ওসমান তরফদার খুবই ব্যস্ত। তিন বিঘা জমির গুটি স্বর্ণ ধান কাটা শেষ। তিনি বললেন, ‘বর্ষায় কিছুটা ক্ষতি হলেও ফলন মন্দ না। ’ স্থানীয় নতুন হাটের ধান ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বললেন, ‘নতুন স্বর্ণ ধান বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ৮৫০ থেকে ৮৬০ টাকা। বিনা-৭ বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ৮৬০ টাকা, হাবু ধান বিক্রি হচ্ছে ৯৫০ থেকে এক হাজার টাকায়। নতুন ধান ওঠার কারণে দাম কিছুটা কমেছে। ’

নওগাঁ প্রতিনিধি ফরিদুল করিম জানান, এবার রোপা আমনের সময় নওগাঁ জেলায় বন্যায় ৩৮ হাজার ৪৩১ হেক্টর ধানি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো ব্যাপকভাবে ধান কাটা শুরু হয়নি। গত বুধবার পর্যন্ত ২৩ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে।

তবে কৃষকরা জানিয়েছে, রোপা আমন চাষে সার, কীটনাশক, জমি প্রস্তুত, ক্ষেতমজুরের পেছনে যে খরচ হয়েছে, তাতে কুলিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে যাবে। সবে হাট-বাজারগুলোতে ধান উঠতে শুরু করেছে। ফলে দাম একটু চড়া। তবে এক সপ্তাহ বাদেই ওই দামে হেরফের হবে। শুকনো ধানের দামই একটু বেশি পড়ছে।

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি সূত্রে জানা যায়, নওগাঁয় এবার রোপা আমন ধান চাষ হয়েছিল দুই লাখ ১৪০ হেক্টর জমিতে। বন্যায় বেশ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত টিকেছে এক লাখ ৬১ হাজার ৬৯৯ হেক্টর জমির ধান। এবার প্রতি বিঘা জমিতে উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে সাড়ে ১৬ মণ। চাল হওয়ার কথা বিঘায় ১১ মণ করে।

রাইগাঁ গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম (৪৫) জানালেন, ধান চাষে যে পরিমাণ খরচ পড়েছে, বিশেষ করে সার ও কীটনাশক ব্যবহারের পেছনে যে খরচ পড়েছে, সেই তুলনায় বাজারে ধানের মূল্য কম। তাই লোকসান হচ্ছে।

ধান ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন খান টিপু বলেন, হাট-বাজারে সবে নতুন ধান উঠতে শুরু করেছে। ব্যাপক হারে ধান উঠতে আরো ৮-১০ দিন অপেক্ষা করতে হবে। যেটুকু ধান হাটে কৃষকরা আনছে, তা ধান কাটার খরচের টাকার জন্য। এ দিয়ে তারা কৃষি শ্রমিকের মজুরিসহ অন্যান্য খরচ মেটাবে। ফলে শুখনো ধানের জন্য আরো সময় লাগবে।

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মনোজিৎ কুমার মল্লিক বলেন, গড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এই কয়েক দিনে ২৩ শতাংশ জমির রোপা আমন ধান কাটা হয়েছে। বন্যা ও বন্যার আগে বৃষ্টিতে রোপা আমন ধান চাষে কৃষকরা চরম বিড়ম্বনায় পড়ে। বন্যার পর অনেক কৃষক চিনি আতপ ধান চাষ করেছে। ওই ধান উঠতে একটু দেরি হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন জাতের ধানের ফলনও পৃথক। ফলে গড় উৎপাদনের হিসাব পেতে একটু সময় লাগবে।